পদার্থের অবস্থা

পদার্থের অবস্থা নিয়ে বলতে গেলে বিশ্বে আমরা যা কিছু দেখতে পাই বা যা কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করি, সব কিছুকে দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়, পদার্থ ও শক্তি। যার ভর আছে, যা কোনো স্থান দখল করে অবস্থান করে এবং তার স্থিতিশীল, গতিশীল অবস্থার পরিবর্তনে বাধা প্রদান করে, তাকে পদার্থ বলা হয়।

শক্তি (Energy)

যার ভর নেই, যেটি কোনো স্থান দখল করে না তাকে শক্তি বলে। যেমন- তাপ, আলো, বিদ্যুৎ, শব্দ, গতি। শক্তির একটা বৈশিষ্ট্য হলো এটি এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তিত হতে পারে। তবে পদার্থেরও একই রকম গুন আছে। তাপ শক্তি থেকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তর হওয়া শক্তির রূপান্তরের উদাহরণ। আবার বরফ গলে পানি হয়ে যাওয়াটা হচ্ছে পদার্থের পরিবর্তনের উদাহরণ।

পদার্থ (Matter)

পৃথিবীতে যেসব বস্তুর নির্দিষ্ট ভর থাকে, যারা কোনো জায়গা বা স্থান দখল করে তাদেরকে পদার্থ বলে। অন্যকথায় বলা যায়, যার জড়তা (inertia) আছে, তাই পদার্থ। কক্ষ তাপমাত্রায় কিছু পদার্থ আছে যারা কঠিন অবস্থায় থাকে, কিছু পদার্থ তরল অবস্থায় থাকে, কিছু পদার্থ গ্যাসীয় অবস্থায় থাকে। আমাদের সবার পরিচিত চিনি, লবণ, চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি কঠিন পদার্থ। আবার পানি, দুধ, কোকাকোলা ইত্যাদি তরল পদার্থ। ওদিকে আমরা বাতাসকে চোখে দেখি না, বাতাস সহ বিভিন্ন গ্যাস যেমন হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন ইত্যাদি গ্যাসীয় পদার্থ। তাই বলা যায়, মহাবিশ্বে আমরা যাদেরকে সচক্ষে দেখি কিংবা যাদের অস্তিত্ব আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা বোঝা যায় তারাই পদার্থ। এবার চলো আমরা এই তিন ধরণের পদার্থের অবস্থা নিয়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করি-

কঠিন পদার্থ (Solids)

কঠিন পদার্থের নির্দিষ্ট ভর, আকার এবং আকৃতি থাকে। তবে আকার এবং আকৃতির মাঝে যারা পার্থক্য বোঝো না, তাদেরকে বলছি- আকার হচ্ছে কোনো বস্তু দেখতে “কেমন”, অর্থাৎ সেটি বৃত্তের মত গোলাকার, নাকি ঘনকের মত বর্গাকার, নাকি সাপের মত সর্পিলাকার। আবার আকৃতি বলতে কোনো বস্তু ” কতটুকু বড় বা ছোট” তা বোঝায়। যেমন চাঁদের আকৃতি পৃথিবীর চেয়ে ছোট, সূর্যের আকৃতি পৃথিবীর চেয়ে বড়। কঠিন পদার্থের মধ্যে থাকা কণা গুলোর মধ্যকার আকর্ষণ অনেক বেশি থাকে বলে এদের প্রকৃতি কঠিন হয়। অণুদের মাঝে এই আকর্ষণের নাম আন্তুঃকণা আকর্ষণ বল। এই বল অনেক বেশি বলে বাইরের থেকে চাপ দিলে কঠিন বস্তু সহজে সংকুচিত হয় না। আবার কঠিন পদার্থে তাপ দিলে তার অণুগুলো খুব মৃদ্যুভাবে কাঁপতে থাকে এবং সহজে অণুগুলো তাদের মধ্যকার আকর্ষণ বল ছিন্ন করে একে অপরের কাছ থেকে সরে যায় না। তাই তাপ দিলে কঠিন বস্তুর আয়তন খুব কম পরিবর্তন হয়।

তরল পদার্থ (Liquids)

কঠিন পদার্থ থেকে সামান্য কোমল একটা পদার্থ হচ্ছে তরল পদার্থ। এর আয়তন আছে কিন্তু আকৃতি নেই। তাই যখন যে পাত্রে তরলকে রাখা হয়, সেই পাত্রের আয়তন ধারণ করে এটি। কঠিন পদার্থের তুলনায় এতে কণা গুলো সামান্য দূরে দূরে থাকে এবং তাদের মাঝে আন্তঃকণা আকর্ষণ বল কিছুটা কম থাকে। বাইরের থেকে চাপ প্রয়োগ করলে তরলের আয়তন পরিবর্তন হয় না কিন্তু তাপ দিলে তরলের আয়তন বাড়ে। কারণ তাপের ফলে তরলের কণাগুলো বেশি পরিমাণ কাঁপতে পারে, কেননা তাদের মাঝে আন্তঃকণা আকর্ষণ বল কঠিনের চেয়ে কম। তাই একটা নির্দিষ্ট তাপ প্রয়োগ করলে কঠিনের আয়তন যতটুকু বাড়ে, তরলের আয়তন তারচেয়েও বেশি বাড়ে।

গ্যাসীয় / বায়বীয় পদার্থ (Gases)

গ্যাসীয় পদার্থের ভর আছে, কিন্তু কোনো আকার বা আয়তন নেই। অর্থাৎ একে যেকোনো বদ্ধ পাত্রে রাখলে এটি ছড়িয়ে গিয়ে পুরো পাত্রের আয়তন দখল করতে পারবে। এর মূল কারণ হচ্ছে অণুসমূহ অধিকতর কম্পন, আবর্তন ও স্থানান্তর গতি সহকারে আন্তঃআণবিক আকর্ষণকে উপেক্ষা করে মুক্তভাবে চলাচল করে। তখন অণুসমূহ পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যেহেতু অণুসমূহ আর পরস্পরের নিকটে থাকে না, সেহেতু গ্যাসীয় অবস্থায় পদার্থের আয়তন কঠিন বা তরল অবস্থা থেকে অনেক বেশি হয়। যেমন 1 kg তরল পানির আয়তন প্রায় 1 L। কিন্তু 100°C তাপমাত্রায় ও এক বায়ুমণ্ডলীয় (1 atm) চাপে 1kg জলীয় বাষ্পের আয়তন প্রায় 1245 L.

আবার গ্যাসীয় পদার্থের কণা গুলোর মধ্যে আন্তঃকণা আকর্ষণ বল অনেক কম থাকে। ফলে একটা কণা আরেকটা কণার কাছ থেকে যথাসম্ভব দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করে। আবার গ্যাসীয় পদার্থে সামান্য পরিমাণ তাপ প্রয়োগ করলে আয়তন অনেক বেড়ে যায়, একই সাথে সামান্য চাপ যদি বাইরের থেকে প্রয়োগ করা হয় তবে তার আয়তন অনেক বেশি কমে যায়। তাহলে বলা যায়, গ্যাসীয় পদার্থের অণুগুলো মুক্তভাবে চলাচল করতে পারে।

পদার্থের-অবস্থা

পদার্থের রূপান্তর / ভৌত অবস্থার পরিবর্তন

সাধারণ অবস্থায় বিভিন্ন পদার্থের তিনটা ভৌত অবস্থা থাকে। সাধারণ অবস্থা বলতে 25°C (298 K) তাপমাত্রা ও এক বায়ুমণ্ডল (1 atm) চাপকে বোঝায়। 25°C তাপমাত্রাকে কক্ষতাপমাত্রাও বলা হয়। আমরা জানি যে, কক্ষতাপমাত্রায় পানি তরল, অথচ লবণ কঠিন, নাইট্রোজেন গ্যাসীয়। যেসব পদার্থের গলনাঙ্ক কক্ষতাপমাত্রার উপরে তা কক্ষতাপমাত্রায় কঠিন পদার্থ হিসেবে থাকে। যে সব পদার্থের স্ফুটনাঙ্ক কক্ষতাপমাত্রার নিচে তা কক্ষতাপমাত্রায় গ্যাস হিসেবে থাকে এবং যে সব পদার্থের গলনাঙ্ক কক্ষতাপমাত্রার নিচে ও স্ফুটনাঙ্ক কক্ষতাপমাত্রার উপরে সে সব পদার্থ কক্ষতাপমাত্রায় তরল হিসেবে থাকে। NaCl লবণের গলনাঙ্ক (815°C) কক্ষতাপমাত্রার উপরে। সুতরাং তা কক্ষতাপমাত্রায় কঠিন। নাইট্রোজেনের স্ফুটনাঙ্ক (-196℃) কক্ষতাপমাত্রার নিচে। সুতরাং তা কক্ষতাপমাত্রায় গ্যাস। অন্যদিকে পানির স্ফুটনাঙ্ক (100°C) কক্ষতাপমাত্রার চেয়ে বেশি এবং গলনাঙ্ক (0°C) কক্ষতাপমাত্রা অপেক্ষা কম হওয়ায় পানি কক্ষতাপমাত্রায় তরল পদার্থ।

সাধারণ তাপমাত্রায় পানি একটি তরল পদার্থ। তাকে ঠান্ডা করলে 0°C তাপমাত্রায় তা কঠিন পানি বা বরফে রূপান্তরিত হয়। এ বরফকে তাপ দিলে তা আবার পানিতে পরিণত হয়। পানিকে তাপ দিলে 100°C তাপমাত্রায় ফুটে বাষ্পে রূপান্তরিত হয়। বাষ্পকে ঠান্ডা করলে তা পানিতে পরিণত হয়। তাকে ঠান্ডা করে 0°C এ নিয়ে গেলে বরফে পরিণত হয়। এরূপভাবে প্রায় সকল কঠিন পদার্থকে তাপ দিলে তারা গলে তরলে রূপান্তরিত হয়। যে তাপমাত্রায় কোনো পদার্থ কঠিন অবস্থা হতে তরলের পরিণত হয়, তাকে সে পদার্থের গলনাঙ্ক (melting point) বলা হয়। তরলকে আরো উত্তপ্ত করলে তা বাষ্পে পরিণত হতে থাকে এবং এক সময় ফুটতে আরম্ভ করে।

যে তাপমাত্রায় কোনো তরল পদার্থ ফুটতে থাকে তাকে সে পদার্থের সস্ফুটনাঙ্ক (boiling point) বলা হয়। স্ফুটনাঙ্ক বাইরের চাপের ওপর নির্ভরশীল। সাধারণত খোলা পাত্রে স্ফুটনাঙ্ক মাপা হয়। তখন তরলের উপরের বায়ুচাপ 1 atm থাকে। সাধারণত বাষ্পকে ঠান্ডা করলে তরল এবং তরলকে ঠান্ডা করলে কঠিন পদার্থের সৃষ্টি হয়। অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে কঠিন পদার্থ উত্তপ্ত করলে সরাসরি বাষ্পে রূপান্তরিত হয়, তাকে ঊর্ধ্বপাতন (sublimation) বলা হয়। যেমন, আয়োডিন এবং ন্যাপথালিন। অপরদিকে অনেক পদার্থ উত্তাপে তরল বা গ্যাস হওয়ার পূর্বেই বিযোজিত বা বিয়োজিত হয়ে যায়।

পদার্থের তিনটি অবস্থায় থাকার মূল কারন

পদার্থের অবস্থা তিনটা থাকার মূল কারণ হচ্ছে তাপ এবং পদার্থের অণুর আন্তঃআণবিক শক্তির পার্থক্য। কারন তাপ প্রয়োগে পদার্থের অণুগুলো কম্পন বা vibration তৈরি করে। ফলে অণুগুলো একে অপরের থেকে দূরে সরে যায় এবং পদার্থের আকৃতি পরিবর্তন হয়। একইসাথে তাপ বর্জনের ফলেও পদার্থ এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পরিবর্তিত হয়। যেমন- মোমবাতির জ্বলন।

আমরা যে মোমবাতি জ্বালাই সেটা বিভিন্ন ধরনের হাইড্রোকার্বনের মিশ্রণ। হাইড্রোজেন এবং কার্বন নিয়ে হাইড্রোকার্বন যৌগ গঠিত। যখন মোমবাতি জ্বালানো হয় তখন এটি একইসাথে কঠিন, তরল এবং গ্যাসীয় অবস্থাপ্রাপ্ত হয়। কিভাবে হয়, চলো সেটা জানার চেষ্টা করি! মোমবাতি সাধারণ অবস্থায় কঠিন পদার্থ থাকে। মোমবাতিতে থাকা সুতাকে যখন জ্বালানো হয় তখন আগুনের তাপে মোম গলে গলে নিচে পড়ে যেটা মোমের তরল অবস্থা। আবার সুতায় থাকা আগুনের ফলে কিছু মোম তাপে বাষ্পে পরিণত হয়, যেগুলো বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে কার্বন-ডাই অক্সাইড, জলীয় বাষ্প, তাপ এবং আলো তৈরি করে। এভাবে মোমবাতির দহনে পদার্থের তিনটি অবস্থা দেখা যায়।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *